শনিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯:৫৮ অপরাহ্ন
এম আই ফারুক আহমেদ, কালের খবর :
ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় জালের মতো ছড়িয়ে আছে অবৈধ গ্যাস সংযোগ। আবাসিক ভবনের ওপর তলা থেকে শুরু করে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, শিল্প কারখানা এমনকি ক্যাপটিভ পাওয়ারেও এর বিস্তৃতি। অভিযান পরিচালনা করে অবৈধ সংযোগ বিছিন্নকরণ এবং জরিমানা অব্যহত রেখেছে তিতাস গ্যাস কোম্পানি। নকশাবহির্ভুত এলাকা থেকে হাজার হাজার ফুট পাইপ লাইনও তুলে ফেলা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে কখনো কখনো স্থানীয়দের বাধার মুখেও পড়তে হচ্ছে।
তবে অভিযোগ রয়েছে, প্রভাবশালী গ্রাহকদের ক্ষেত্রে বিশেষকরে শিল্প কারখানা ও ক্যাপটিভ পাওয়ারে যারা বাইপাস (মিটার বহির্ভূত পাশ্বসংযোগ) করে অবৈধভাবে গ্যাস ব্যবহার করছেন, তাদের বেলায় ‘অনেকটাই নমনীয়’ এই কোম্পানি। তথ্য পাওয়ার পরও ‘নিরব থাকা’, অনেক সময় সংযোগ বিচ্ছিন্ন ও জরিমানা করা হলেও তা আদায়ে জোরালো ভূমিকা না নেয়ার অভিযোগও রয়েছে।
আরও অভিযোগ, বড় অঙ্কের জরিমানা করার পর নেগোশিয়েশনের (আলোচনা) মাধ্যমে তাদের জরিমানা মাফ করে কিংবা হ্রাস করে পুনরায় সংযোগ দেয়া হচ্ছে। জরিমানা কমানো বা মাফ করার ক্ষেত্রে কয়েকটি সিন্ডিকেট আছে। রাজনৈতিক কর্মী পরিচয় দেয়া কিছু ব্যক্তি এবং অখ্যাত কিছু গণমাধ্যমকর্মী এই সিন্ডিকেটের অংশ। পেট্রোবাংলা, তিতাস এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এর নেপথ্যে কলকাঠি নাড়েন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
পেট্রোবাংলার সাবেক এক কর্মকর্তা সংবাদকে বলেন, ‘বাইপাস ধরা পড়েছে, এমন বড় বড় প্রতিষ্ঠানও আছে। হয়েছে কী? লাইন কাটা হয়েছে, জরিমানা হয়েছে। কেউ জরিমানা দিয়েছে, আবার কেউ নানা উপায়ে পার পেয়ে গেছে। কখনো উপর থেকে ফোন আসে, কখনো নানা মহলের তদবির আসে। কিছু করা যায় না।’
তিনি বলেন, ‘গ্যাস চুরির দায়ে বড় ধরণের সাজা তো হয়নি। জেল হয়েছে কারো? কোন মালিক কারাগারে সাজা ভোগ করছেন এমনটা কি আমরা দেখেছি?’
**তিতাস গ্যাস**
রাষ্ট্রীয় ৬টি গ্যাস বিতরণ কোম্পানির মধ্যে সবচেয়ে বড় হচ্ছে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি। দেশে প্রতিদিন যে পরিমাণ গ্যাস বিতরণ করা হয় তার প্রায় ৫৫ শতাংশ বিতরণ করে তিতাস গ্যাস কোম্পানি। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, জামালপুর, শেরপুর, নরসিংদী, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জ জেলায় গ্যাস বিতরণ করে এই কোম্পানি।
২০২৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত হিসাব অনুযায়ী, তিতাসের মোট গ্রাহক সংখ্যা ২৮ লাখ ৭৮ হাজার ৭৫৭। এরমধ্যে, আবাসিক গ্রাহকের সংখ্যা ২৮ লাখ ৫৩ হাজার ৫৩।
বাকি যেসব সংযোগ রয়েছে তারমধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে ৫৬টি, সার কারখানা ২টি, শিল্প সংযোগ ৫৪২৯টি, ক্যাপটিভ পাওয়ার ১৭৫৫টি, সিএনজি ফিলিং স্টেশন ৩৯৬টি, বাণিজ্যিক সংযোগ রয়েছে ১২ হাজার ৭৮টি।
কোম্পানির তথ্য এবং স্থানীয় সূত্র অনুযায়ী, তিতাসের আওতাভুক্ত এলাকায় হাজার হাজার আবাসিক এবং শত শত বাণিজ্যিক ও শিল্প সংযোগ রয়েছে অবৈধ। ফলে তিতাসের সিস্টেম লসের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭ শতাংশ।
সিস্টেম লস
গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে গ্যাস ক্রয়ের (আমদানীকৃত এলএনজিসহ) পর তা গ্রাহকদের কাছে বিক্রি করে তিতাস গ্যাস কোম্পানি। যে পরিমান গ্যাস ক্রয় করা হয়, সেই পরিমাণ বিক্রির হিসাব পাওয়া যায় না। বিক্রির পরিমাণ কম হয়। ক্রয়-বিক্রয়ের এই যে পার্থক্য হয় তা সিস্টেম লস হিসেবে দেখায় কোম্পানিটি।
পেট্রোবাংলার সাবেক এক পরিচালক সংবাদকে বলেন, ‘তিতাস গ্যাস একটি বড় কোম্পানি। এর ডিস্ট্রিবিউশন লাইন পুরোনো। এতে সিস্টেম লস হবে। কারিগরি কিছু কারণেও লস হয়। এরপরও, সবমিলিয়ে সিস্টেম লস ২ শতাংশের বেশি হওয়ার কথা নয়।’ তিনি বলেন, ‘চুরি যাওয়া সব গ্যাস সিস্টেম লস দেখানো হয়।’
তিতাস গ্যাস কোম্পানির হিসাব বিভাগের সূত্র অনুযায়ী, ৭ শতাংশ সিস্টেম লস মানে হলো প্রতি মাসে ১৫০ থেকে ১৮০ কোটি টাকা লোকসান। যা বছরে দাঁড়ায় ১৮০০ কোটি থেকে ২১৬০ কোটি টাকা।
তিতাসের সঙ্গে অন্য পাঁচটি গ্যাস বিতরণ কোম্পানির সিস্টেম লসের আর্থিক মূল্য যুক্ত করলে তা মোট বছরে ৩০০০ কোটি টাকা দাঁড়াবে বলে জানান সাবেক এই কর্মকর্তা।
**তিতাস এমডির বক্তব্য***
অবৈধ সংযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন এন্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী শাহনেওয়াজ পারভেজ সংবাদকে বলেন, অবৈধ সংযোগ উচ্ছেদে অভিযান চলমান আছে।
তিনি জানান, তিনি দায়িত্ব পেয়েছেন দেড় মাসের কিছু বেশি সময় হয়েছে। এরমধ্যে বেশকিছু অভিযান তিনি পরিচালনা করেছেন।
এমডির তথ্য অনুযায়ি, ‘গত ৮ সেপ্টেম্বর থেকে ২২ অক্টোবর পর্যন্ত ৪৫ দিনে তিতাস গ্যাসের আওতাধীন এলাকায় ৫ হাজার ২৯৪টি অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। এর মধ্যে আবাসিকে অবৈধ সংযোগ ছিল ৫ হাজার ১৭০টি। বাণিজ্যিকে ৪৬টি আর শিল্পে ৭৮টি। এ সময় ২৯ কিমি পাইপলাইন অপসারণ করা হয়। এর ফলে দিনে ৪১ লাখ ৩৭ হাজার ৫৩ ঘনফুট গ্যাস সাশ্রয় হয়। এ সময়ে দৈনিক ২০ লাখ ১৫ হাজার টাকার গ্যাস সাশ্রয় হয়।’
ঢাকার কেরাণীগঞ্জ, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চলছে। তবে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় দৃশ্যমান অনেক অবৈধ সংযোগ লাইন রয়েছে। সেখানে অভিযান হচ্ছে না কেন? সংবাদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিতাস এমডি বলেন, ‘গজারিয়ায়ও অভিযান হবে। তবে জনবল ও প্রশাসনের সহযোগিতার বিষয় আছে। সব জায়গায় একবারে অভিযান সম্ভব নয়।’
অভিযান বছর (২০২৩ সাল) দেশে অবৈধ গ্যাস-সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার জন্য মোট ১৮৬টি অভিযান পরিচালনা করা হয়। এসব অভিযানে মোট ২ লাখ ১৯ হাজার ২৬৫টি চুলা এবং ৭টি শিল্পগ্রাহকের অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে, যার ফলে দিনে প্রায় ২ কোটি টাকার গ্যাস সাশ্রয় হচ্ছে বলে তথ্যে দাবি করা হয়।
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ৯৫টি অভিযান পরিচালনা করা হয়। এ সময় সোয়া লাখ চুলার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। শিল্প খাতের ৭৪টি অবৈধ গ্যাস-সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। পেট্রোবাংলার দাবি, এর ফলে দৈনিক ১ কোটি ৪১ লাখ টাকার গ্যাস সাশ্রয় হয়।
**পুনঃসংযোগ**
অভিযানে বিচ্ছিন্ন করা সংযোগ কত দিন বিচ্ছিন্ন থাকবে, তার কোনো নিশ্চয়তা দিতে পারে না তিতাস কোম্পানি। পূর্বে দেখা গেছে, বিচ্ছিন্ন করার সপ্তাহখানেকের মধ্যেই আবার সংযোগগুলো পুনঃস্থাপিত করে নেয়া হয়। এভাবেই চলতে থাকে অভিযানে লাইন কাটা আবার সংযোগ নেয়ার খেলা।
**স্থানীয় মতামত**
যেসব এলাকায় অবৈধ সংযোগ বেশি, সেখানেও এমন কিছু মানুষ রয়েছেন যারা অবৈধ সংযোগ নেননি। তাদের মতে, গ্যাস চুরি বন্ধ করতে হলে স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সাধারণ মানুষের সমন্বিত কমিটি গঠন করতে হবে। গ্যাস চুরি বন্ধে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। মসজিদে এ বিষয়ে ধর্মীয় অনশাসনের আলোকে আলোচনার ব্যবস্থা করতে হবে। তারা বলছেন, গ্যাস চুরি করে জেল হয় এমন নজির দেখা যায় না। এ বিষয়টিও সরকারকে আমলে নিতে হবে।
**পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানের বক্তব্য**
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার সংবাদকে বলেন, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের নির্দেশে পেট্রোবাংলা কর্তৃপক্ষ অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে সম্প্রতি কার্যক্রম জোরদার করেছে। জনেন্দ্র নাথ বলেন, ‘অবৈধ গ্যাস সংযোগ চিহ্নিত করে উচ্ছেদ করতে না পারলে সিস্টেম লস থেকে বের হওয়া যাবে না। আমরা অভিযান আরও জোরদার করার জন্য স্থায়ীভাবে ম্যাজিস্ট্রেট আনার চেষ্টা করছি।’
**গ্যাস সঙ্কট**
বাংলাদেশে তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) সূত্রে জানা যায়, দেশে বর্তমানে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ৩৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট (এমএমসিএফ)। এর মধ্যে গড়ে ৩০০০ এমএমসিএফ সরবরাহ করা হয়।
গ্যাসের চাহিদা প্রতি নিয়ত বাড়ছে, কমছে উৎপাদন। বর্তমানে দৈনিক উৎপাদন হচ্ছে ১৯৬০ এমএমসিএফ। আর কক্সবাজারের মহেশখালীতে দুটি ভাসমান টার্মিনালের মাধ্যমে এলএনজি (তরলীকৃত প্রকৃতিক গ্যাস) থেকে সরবরাহ সক্ষমতা ১১০০ এমএমসিএফ। এখন সরবরাহ হচ্ছে ৮২০ এমএমসিএফ। এতে দিনে এখন গ্যাস সরবরাহ নেমে এসেছে ২৭৮০ এমএমসিএফ।
সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর এবং ঢাকার বেশ কিছু এলাকায় গ্যাস সঙ্কট বেড়েছে। এসব এলাকার আবাসিক গ্রাহকদের ভোগান্তির পাশাপাশি শিল্পকারখানার উৎপাদনও ব্যাহত হচ্ছে।
গ্যাসের সরবরাহ বাড়াতে খোলাবাজার থেকে আরও এলএনজি কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জ্বালানি বিভাগ। ইতোমধ্যে এলএনজি কেনা শুরু করেছে পেট্রোবাংলা। একটি এলএনজি জাহাজ দেশে পৌঁছার পর সরবরাহ বেড়েছে। শিগগিরই আরেকটি জাহাজ এসে পৌঁছানোর কথা রয়েছে।